১৮ শতকের বিখ্যাত জার্মান কবি ও দার্শনিক ‘জোহান গথে’ বলেছিলেন,
‘ যদি কাল কিছু অর্জন করতে চাও,
তবে আজ থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করো’
হ্যাঁ – আমি আনোয়ার এইচ. জোয়ারদারের কথা বলছি। উনি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন সেই ছোট্ট বেলা থেকে। ডুমুরিয়া থানার হাসানপুর গ্রামের কালাচাঁদ জোয়ারদারের ঘরে জন্ম নেওয়া সেই ছোট্ট Anwar H. Joarder এর নাম এখন Google এ আন্তর্জাতিক Scholar এর তালিকায় দেখা যায়। উনার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল সেদিন – যেদিন উনার মা উনাকে বলেছিলেন, “তোমাকে কামাই করা লাগবে না, তুমি লেখাপড়া শিখে মানুষ হও ।” সেই ছোট্ট আনোয়ার তখন কামাই করা এবং মানুষ হওয়া এই শব্দের অর্থ বুঝতো না। তবে স্বপ্ন সব সময় একা পূরণ করা যায় না – কাছের মানুষের ভালবাসা লাগে কখনো কখনো। উনার বড় ভাই নিজে উপার্জনের পথ বেছে নিয়ে ভাইকে হাসানপুর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
শুরু হলো ছোট্ট শিশুর সংগ্রাম। প্রথম দিন স্কুলে ঘুঘুমোড়া দিতে হয়েছিল শুধুমাত্র স্কুল কামাই করেছে সেই অপরাধে। অথচ শিক্ষক একবারও চিন্তা করেনি এই বাচ্চার সেদিন ছিল স্কুলের প্রথম দিন। ছোট্ট আনোয়ারের মনে অনেক প্রশ্ন জাগতো, কিন্তু স্কুলে প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে মারতো। তবে বালক তার প্রতিভা দেখাতে পেরেছিলেন একবার – পুরা শতকিয়া লিখে ফেলেছিলেন পাশের বন্ধুর লেখা একবার দেখেই। সমস্যা হলো একটাই, বালকের পাটিগণিত কিছুতেই মাথায় ঢুকতো না। শিক্ষকরা প্রশ্ন করলে মারবে সেই ভয়ে বালক পাটিগণিত মুখস্ত করে ফেলল। সে গণিতের ব্যাপারটা এতটাই চিন্তা করতো যে পরীক্ষার আগের দিন রাতে বালক সাত নম্বর অংকটা স্বপ্নে দেখলো !
এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে হাইস্কুল মিকশিমিল রুদাঘরা উচ্চ বিদ্যালয়ে কিশোরের স্বপ্নের কাছাকাছি যাওয়ার পথ শুরু হলো। একদিন অংক বইয়ে বীজগণিত- জ্যামিতি দেখে তার মনে আনন্দের সীমা নেই। কৌতুহল থেকে উনি দেখেন বইটির লেখক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিসংখ্যান বিভাগ। সেই থেকে উনার মনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়ার এবং শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। তার আগ্রহ সব বিষয়ে কিন্তু, বেশি আগ্রহ অংক আর বিজ্ঞানে। এই স্কুলের কিছু শিক্ষক তার প্রশ্নের উত্তর দিতে আরম্ভ করলেন। যেই সব ব্যাপারে বালকের আগ্রহ তৈরী হলো, তখনি শুরু হলো ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ।
উনি ১৯৭১ সালে ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রতি সপ্তাহে স্কুলে যেয়ে সায়েন্স ল্যাবে সব ঠিক আছে কিনা সেটা দেখে জানালা বন্ধ করে আসতেন। উনি যে এ কাজটা করতে যেতেন তা খুব গোপনে করতেন যেন কেউ বুঝতে না পারে! উনার বয়সী ছেলেরা হয়তো তখন পাড়ার দোকানে আড্ডা দিত, আর উনি চিন্তা করতেন কিভাবে স্কুলের ল্যাবরেটরী রক্ষা করা যায় ! একসময় যুদ্ধ শেষ হলো। ক্লাস এইটে আর পড়া হলো না সরাসরি নাইনে পড়তে হলো। উনি ক্লাসের 1st Boy , নিতে চাইলেন মানবিক বিভাগ। কারণ উনি ডাক্তার/ ইঞ্জিনিয়ার হতে চান না। তাছাড়া সায়েন্স নিলে প্রাইভেট পড়া লাগবে, সেটা ভেবেই উনি মানবিক বিভাগ বেছে নিলেন এবং ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়া আর পিএইচ ডি করার চিন্তা করতে থাকলেন।
ছোটবেলা থেকে প্রচন্ড ধার্মিক আনোয়ার জোয়ারদারের মানবিক বিভাগে কিছুদিন পড়ার পর সব বিষয় সহজ লাগত। একসময় উনি শুনলেন মানবিক বিভাগে পড়েও Elective Math নেয়া যায়। ততদিনে সময় চলে গেছে অনেকদিন। এই সময়ে এগিয়ে এলেন স্কুলের অংক শিক্ষক বাবু বিমল কুমার সাহা। উনি ছাত্র আনোয়ারের প্রতিভা ধরে ফেললেন। এই শিক্ষক অংকের সমস্ত কলা কৌশল এই কৌতুহলী ছাত্রকে শেখালেন। ছাত্র এবার মনের আনন্দে ১০০ বছরের Calendar বানিয়ে ফেললেন। বাসায় একা একা পদার্থবিজ্ঞান পড়তে লাগলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ তকিমউদ্দিন এবং সকল শিক্ষক বুঝেছিলেন সেবার ঐ স্কুল থেকে সে ভাল রেজাল্ট করবে।। বিশেষ করে বিমল স্যার বললেন, সে 1st stand করবে । ১৯৭৪ সালে উনিই মানবিকে যশোর বোর্ডে প্রথম হন।
আর পিছনে তাকাতে হয়নি, তবে সংগ্রাম তিনি অব্যাহত রাখেন। খুলনার সরকারী বি.এল কলেজ থেকে এইচ এস সি তে ১৯৭৬ সালে যশোর বোর্ডে 2nd Stand করেন। বি. এল কলেজের কিছু শিক্ষক উনাকে ব্যক্তিগতভাবে লেখাপড়ায় অনেক সহযোগিতা করেছিলেন।
শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়। উনি প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন। পরিসংখ্যান বিভাগের একজন অধ্যাপক উনাকে সেখানে পড়তে এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কথা বলেন। কিন্তু উনার মন পড়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের পরিসংখ্যান বিভাগে। মাত্র ১০০ টাকা নিয়ে উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা হলেন। উনি বিশ্ববিদ্যালয়র পরিসংখ্যান বিভাগে এসে দেখেন কাজী মোতাহার হোসেনের ছবি রাখা আছে। উনি ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। এরপর ইতিহাস একটার পর একটা :
B.Sc. Honors in Statistics (1982), First Class, Second Position: University of Dhaka, Bangladesh (Outstanding Grades in almost all 6 units of mathematics)
M.Sc. in Statistics, Thesis Group (1985), First Class, First Position (Average Grade 72): University of Dhaka, Bangladesh
পরিসংখ্যানের জটিল তত্ত্ব উনি যতটা শিখেছেন ক্লাসে তার চেয়ে বেশি শিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কালিপদ সেনের ব্যক্তিগত তত্বাবধানে। ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়ে অথবা নিয়তি হয়তো চাইনি উনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেখতে। কিন্তু শিক্ষক তো উনাকে হতে হবে, তাই উনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কিন্তু ক্লাস নেওয়ার আগেই উনি Commonwealth Scholarship নিয়ে যান কানাডা। শুরু হলো উনার পরবর্তী পথচলা :
University of Western Ontario, Canada তে উনি Ph.D. in Statistics (1992) শেষ করেন।
PhD Thesis: Estimation of the Scale Matrix of a Multivariate T-Model, The thesis required strength in Linear Algebra, Matrix Analysis, Probability Theory, Multivariate Statistics etc.
উনি বিশ্বের ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। সেগুলো হলো Canada, Bangladesh, Australia, Brunei, Oman and Saudi Arabia তে অবস্থিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
King Fahd University of Petroleum & Minerals (KFUPM), Saudi Arabia (1997-2014);
University of Sydney, Australia (1996-1997: Two Year Fixed Term Contract);
Monash University, Clayton, Melbourne, Australia (1995-1996);
North South University, Bangladesh (1994);
University of Dhaka, Bangladesh (1993-1995);
University of Western Ontario, London, Canada (1992-1993).
প্রফেসর জোয়ারদার (aj.variance@gmail.com) সম্প্রতি Doctorates of Dumuria : Sonamukh নামে একটি বই সম্পাদনা করেছেন। যা জুলাই ২০২১ এ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পেতে Mr. Kamrul Islam, (amkamrulislam@gmail.com/ 01971 809780) এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সর্বশেষে বলবো আনোয়ার এইচ জোয়ারদারকে মেধার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রমও করতে হয়েছে- তাইতো গণিত এবং পরিসংখ্যানের উপর উনার ৮৫ টা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। উনার ফর্মুলা বিশ্বের ১৪ জন বিজ্ঞানী অন্তত ১৪ বার ব্যবহার করেছেন। উনি বিনয়ের সাথে বলেন “There are many Bangladeshis who have higher h-indices than me. I am happy that I worked on popular problems of statistics and probability theory. Since 2014, Glory be to Allah, my theory of probability is adapted in a-level books of UK. My theories appear also in many other text books.”
রালফ ওয়ালডো এমারসন (দার্শনিক) এর উক্তি দিয়ে শেষ করি- “পথ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যেও না। যেদিকে কোনও পথ নেই, সেদিকে হাঁটো এবং নিজের চিহ্ন রেখে যাও।”
আনোয়ার এইচ. জোয়ারদার আলোর দিশারী, তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উনার মূল্যবান গবেষণা রেখে যাচ্ছেন। আমরা উনার জন্য গর্বিত ।
খুলনা গেজেট/এমএইচবি